নিউজ ডেস্ক::
দেশের ২৯টি জেলার সীমান্ত এলাকায় অবৈধভাবে বেস ট্রান্সিভার স্টেশন (বিটিএস) বা টাওয়ার স্থাপন করায় বাংলালিংককে ১৭ কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিটিআরসি। সীমান্ত এলাকায় ৪৩৩টি টাওয়ার অনুমোদনহীন স্থাপনের অভিযোগ পাওয়া গেলেও মূলত ১০৯টি টাওয়ারের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। বুধবার কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে এই জরিমানার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গত বছর প্রিয়.কমের এক বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায় দেশের সীমান্ত এলাকায় অনুমোদনহীন মোট ৪৪৬টি টাওয়ার স্থাপন এবং বাংলালিংকের সাথে অন্য অপারেটরের শেয়ার করা ১৮১টি টাওয়ারের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর বিটিআরসি এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে ২৯টি জেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলালিংকের নিজেদের স্থাপন করা ৪৩৩টি এবং ৩০টি জেলার সীমান্ত এলাকায় অন্য অপারেটরদের সাথে শেয়ার করা ১৮১টি টাওয়ার অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে।
বিটিআরসি বলছে, অনুমতি ছাড়া সীমান্ত এলাকায় ২০১৩ সালে বিটিএস স্থাপন করলেও বাংলালিংক ২০১৬ সালের ২২ জুন বিটিআরসির কাছে এ বিষয়ে অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠায়। তবে পরবর্তীতে চিঠি পাঠানো হলেও ওই সময়ে স্থাপন করা কোনো বিটিএস-এর অনুমতি দেয়নি বিটিআরসি।
ওই চিঠিতে ৪৪৬টি বিটিএস-এর অনুমতি চায় দেশের এই বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরটি। কিন্তু বিটিআরসি অনুসন্ধান করে দেখে সেখান থেকে ১৩টি বিটিএস-এর অনুমোদন আগেই দেওয়া ছিল। বাকি ৪৩৩টি বিটিএস অনুমতি ছাড়া স্থাপন করা হয়েছে। যা রয়েছে সীমান্ত এলাকার ০ দশমিক ১৪ থেকে ৮ কিলোমিটারের মধ্যে।
এদিকে অনুমতি ছাড়া অন্য অপারেটরদের সঙ্গে ১৮১টি শেয়ার করা বিটিএস সীমান্ত এলাকায় ০ দশমিক ৩৩ থেকে ৭ দশমিক ৯৯ কিলোমিটারের মধ্যে। বাংলালিংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্য অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোনের সঙ্গে ১৩৭টি, রবির সঙ্গে ৩০টি এবং এয়ারটেলের সঙ্গে ১৪টি শেয়ার করা হয়েছে। বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, রবির সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ৩০টি শেয়ার করা বিটিএস-এর বিবরণ দিলেও রবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩১। অপারেটরটি অতিরিক্ত একটি বিটিএস-এর তথ্য গোপন করেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলছে, যখন বাংলালিংকের অনুমোদন বিহীন বিটিএসগুলোর অনুমোদন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তখন আরও একটি বিটিএস বিটিআরসিকে অবহিত না করেই রবির সঙ্গে শেয়ার করেছে অপারেটরটি। এরপর গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর বাংলালিংকের অবৈধ এসব বিটিএস বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা সঞ্জয় ভাগাসিয়া বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ক্ষমা চেয়ে বিটিএসগুলোর অনুমোদন দিতে কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান তিনি।
এরই মধ্যে বিটিআরসির এক কমিশন বৈঠকে সীমান্ত এলাকায় বাংলালিংক অবৈধ বিটিএস স্থাপন করলেও তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিটিআরসির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা যুক্তি খন্ডন করে প্রিয়.কম-কে বলেন, এর আগে সীমান্ত এলাকায় অনুমোদনহীন বিটিএস স্থাপন করার পরেও এয়ারটেলকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল, তাই বাংলালিংকও ক্ষমার দাবিদার। লেবেল প্লেইন ফিল্ড তৈরি করার জন্য ২০১৩ সালের আগে বাংলালিংকের স্থাপন করা সকল অনুমোদনহীন বিটিএস-এর অনুমোদন দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের পর যেসব বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে, সেসবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে আছে। মূলত নিরাপত্তা ইস্যুটি দেখার পরে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
২০১৩ সালের পর সীমান্তে কী পরিমাণ বিটিএস অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছিল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের পর দুই রকম ক্যাটাগরিতে টাওয়ার স্থাপনের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে বাংলালিংক নিজেরা স্থাপন করেছিল ৪০টি টাওয়ার, অন্যদিকে ৬৯টি টাওয়ার অন্য অপারেটরদের সাথে শেয়ার করেছিল। বাকিগুলো ২০১৩ সালের আগে করা হয়েছে।’
বাংলালিংকের বিরুদ্ধে ৪৪৬টি টাওয়ারের বিষিয়ে অভিযোগ উঠলেও ২০১৩ সাল পরবর্তী স্থাপন করা বাংলালিংকের ৪০ ও অন্য অপারেটরদের সাথে শেয়ার করা ৬৯টি টাওয়ারসহ মোট এই ১০৯টি অবৈধ টাওয়ারের বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছিল বিটিআসি। অবশেষে গত বুধবার বিটিআরসির সরবশেষ কমিশন বৈঠকে ১০৯টি অনুমোদনহীন টাওয়ারের জন্য ১৭ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১৯ মে সপ্তম এসএমসি সভা ও একই বছরের ৮ জুন বিটিআরসির ১৯তম কমিশন বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে ৮ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিটিএস স্থাপন করার দরকার হলে নিরাপত্তা ছাড়পত্র এবং বিটিআরসি থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এরপর ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৫৩তম এসএমসি ও ১২ সেপ্টেম্বর বিটিআরসির ১১৯তম বৈঠকে বলা হয়, সীমান্ত এলাকায় বিটিএস স্থাপনের বিষয়ে ভারতের বিধিনিষেধ শিথিল করার কারণে নিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়াই শর্তসাপেক্ষে বিটিএস স্থাপনের অনুমতি দেবে বিটিআরসি। আর সেই নিয়মটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বাংলালিংক এই নিয়ম ভঙ্গ করেই বিটিএস স্থাপন করে সীমান্ত এলাকায়।
এর আগে ২০১৩ সালে সদ্য একীভূত হওয়া মোবাইল ফোন অপারেটর এয়ারটেলের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। অপারেটরটি দেশের ৮টি জেলায় ভারত-বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে অনুমোদনহীন ১৯১টি অবৈধ বিটিএস স্থাপন করেছিল। অনুমোদন ছাড়া বিটিএস স্থাপনের অপরাধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শেষ পর্যন্ত এয়ারটেলকে ক্ষমা করে দেয় বিটিআরসি। ২০১৩ সালের ১২ জুন কমিশনের ১৫৪তম বৈঠকে এটিকে ‘ক্ষমা সুন্দর’ দৃষ্টিতে নিয়ে ঘটনাত্তোর বা পোস্ট ফ্যাক্ট অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে শাস্তির জায়গায় ভবিষ্যতের জন্য তাদের সতর্ক করা হয়।
২০১৩ সালের মে মাসে ১৫১তম কমিশন বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন ইঞ্জিনিয়ারিং ও অপারেশন বিভাগের কমিশনার এ টি এম মনিরুল আলম। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘বিটিএস স্থাপন সংক্রান্ত কমিশনের সুস্পস্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কী পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ছাড়পত্র এবং কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে সীমান্তবর্তী বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেডকে পত্র প্রেরণের সিদ্ধান্ত হলো।’
তবে এয়ারটেল তাদের ব্যাখ্যায় জানিয়েছিল, বিটিআরসি’র কঠিন রোল আউট অবলিগেশনের জন্য দ্রুততার সঙ্গে রোল আউট করতে গিয়ে তারা ‘ভুলক্রমে’ বিটিআরসি’র কাছ থেকে অনুমোদন গ্রহণ করেনি। তাছাড়া অনেক সময় রোল আউটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়াকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এয়ারটেল। ব্যাখ্যায় এয়ারটেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহবান জানিয়ে অনুমোদন চাইলে বিটিআরসি ক্ষমা করে দেয়।
পাঠকের মতামত